Bella Ciao (বিদায় সুন্দরী)
উনা মাতিনা, মি সোনো আলযাতো
ও বেল্লা চাও বেল্লা চাও, বেল্লা চাও চাও চাও।
উনা মাতিনা, মি সোনো আলযাতো
ই হো ত্রোভাতো ল’ইন ভা সোর……
সুদূর ইতালির এই লোকগীতি, হঠাৎ বর্ডার পেরিয়ে সবার মুখে মুখে। অর্থ, ভাষান্তর ছাড়াই গানের সুর আর বুলি জেঁকে বসেছে সবার মনে। নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় সিরিজ ‘লা কাসা ডি প্যাপেল’ এর সূত্রে বিশ্বব্যাপী বর্তমান প্রজন্মেরও মন জয় করেছে এই গান। স্প্যানিশ অরিজিনেটেড এই সিরিজের প্রথম সিজনের এপিসোড ১১ তে এ গান গাইতে দেখা যায়। জেনে নেয়া যাক এ গানের বৃত্তান্ত।
নেটফ্লিক্স অরিজিনাল সিরিজ “লা কাসা ডি প্যাপেল” বা এর ইংরেজি সংস্করণ “মানি হাইস্ট” এ প্রথম এ গানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় এর কেন্দ্রীয় দুই চরিত্র ‘’সালভাদর’’ আর তার বড় ভাই ‘’আন্দ্রেস’’। যারা ছদ্মনাম ‘’প্রফেসর’’ এবং ‘’বার্লিন’’ নামে বেশি পরিচিত।
মাস্টারমাইন্ড এ প্রফেসরের জীবন যে নির্দিষ্ট আইডিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা তা হচ্ছে ‘’প্রতিরোধ’’। ইতালিতে ফ্যাসিবাদীদের বিপক্ষে লড়াই করা দাদার কাছ থেকে শেখা এ গান সালভাদর আর আন্দ্রেসের কাছে প্রতিরোধের প্রতীক।
ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়, যখন প্রথম কোন ক্ষমতা জন্ম নেয়, মানুষ একজোট হতে শুরু করে। এমনকি ভিন্ন ভিন্ন কারণ থাকলেও ধীরে ধীরে একই লক্ষ্যে লক্ষ্য রেখে গণ-বিক্ষোভের আয়োজন শুরু করে; এরপর, একটি নির্দিষ্ট সময়ে, একটি প্রতীকী ঘটনা ঘটে যা সেই যুগকে চিহ্নিত করে। এমন একটি ঘটনা যা তখন কেবল স্মৃতিতে থেকে যায় বা ধারণাগুলো দিয়ে অনুপ্রাণিত করে বেঁচে থাকে।
গানটির প্রাচীনতম লিখিত সংস্করণটি ১৯০৬ সালের, পুরো ইতালীয় ইতিহাসজুড়ে বিকশিত। ইতালীয় এ লোকসঙ্গীত ১৯ শতকের শেষের দিকে ফিরে আসে। প্রথমবার ইতালির পো উপত্যকার ধানচাষিদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। মূলত, এটি উত্তর ইতালির “মন্ডিন” এর একটি ঐতিহ্যবাহী গান। উত্তর-পূর্ব ইতালিতে নারীরা ধানের জমিতে কাজ করার সময়ে এ গান গাইতো। ধান চাষ কঠোর পরিশ্রমের ব্যাপার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটুসমান পানিতে পিঠ বাঁকিয়ে কাজ করা, তাও খুব কম পারিশ্রমিকে। আমাদের উপমহাদেশে এ কাজ খুব সাধারণ মনে হলেও তাদের কাছে এ হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর কাজের ধরন ধীরে ধীরে বড় আকৃতির প্রতিবাদ, দাঙ্গা, ফ্যাসাদের সূচনা করতে থাকে।
১৯৪৩ সালের দিকে গানের কথাগুলো মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী শাসন এবং তাদের নাৎসি মিত্রদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতিবিম্ব হিসেবে প্রচলন ঘটে। সেই সময় থেকে, এটি ইতালি এবং ইউরোপের আশপাশে সাধারণ মতবিরোধের গানে পরিণত হয়।
এ গানের কথাগুলো যেন পর্যায়ক্রমে আনফোল্ড করতে থাকে। প্রতিটা লাইনের সঙ্গে সঙ্গে এর ক্ষিপ্ততাও বেড়ে যায়। স্পষ্ট হয় এর গায়িকা অসহায় না, বরং এত বাধা উপেক্ষা করেও সে সক্ষম এবং ধৈর্য ধরে স্রোতের ধারা পালটে দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। গানের শেষ লাইনের অর্থ ‘’এমন সময় আসবে যখন আমরা সবাই স্বাধীনভাবে কাজ করতে শুরু করবো।‘’
এ গানের অন্য এক সংস্করণ গানটিকে বিষিয়ে তুলতে বাধ্য করে।
১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ এর সময় ইতালি আক্রমণকারীদের এক সৈনিক ইতালিয়ান পার্তিজান বাঁ প্রতিবাদীদের দলবেধে কান্নার মুহূর্তে গানটির কথা পালটে “ধানক্ষেত” কথাটির বদলে “স্বাধীনতার জন্য মৃত্যু” যোগ করে দেয়।এটা এমন এক সময় যখন ইতালির লোকেরা একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে লড়ছিল, অন্যদিকে ফ্যাসিবাদী শাসক বেনিতো মুসোলিনির সঙ্গে গৃহযুদ্ধে।
ইতালির প্রায় প্রত্যেক পরিবারকে কোনো না কোনোভাবে এই দুঃসময়ের আভা স্পর্শ করে। এ গানের ধ্বনি এখনও সেই সময়কে মনে করিয়ে দেয়, যখন প্রায় ৮০ হাজার সাধারণ মানুষ যুদ্ধের শিকার হয়ে মারা পড়ে। এ কারণে ইতালির অনেক জায়গায় “বেল্লা চাও” কে কিছুটা দুঃসহনীয় ভাবে বিরক্তির সঙ্গে দেখা হয়।
১৯৬৪ সালে স্পলেতোতে ‘আ ফেস্টিভ্যাল অফ টু ওয়ার্ল্ডস’ এ ‘বেল্লা চাও নামের’ এক শো বিতর্কের জন্ম দেয়। যা অর্ধশত বছর আগেরকার লোকগাঁথা ফিরিয়ে আনে। ১৯৮০ এর মধ্যবর্তী সময়ে যুগোস্লাভ সমাজ সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে ধুঁকছিল। বিখ্যাত “কুদ ইদিহোতি” ব্যান্ড ফিরিয়ে আনে “বেল্লা চাও” কে। “ডিজল্যুশন ওয়ার” এর সময় থেকে এ গান আবার কালের গহবরে হারিয়ে যেতে থাকে। তবে ৯০ এর দশকে “মানু চাও” এর অনুবাদ এ গানকে আবার উজ্জীবিত করে একে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়।
‘’এটা নিশ্চয়ই এমন একটা গান যা সাধারণের সীমানার বাইরে, জানামতে বিশ্বের সেরা গানগুলর অন্যতম। বেল্লা চাও গায়ক, সাধারণ মানুষসহ অনেকের গাওয়া। অনেকের ভিড়ে মানু চাও থেকে গোরান বেগোভিচ, টম ওয়েটস থেকে ডন আন্ড্রেয়া গ্যালো। এ গান বিশ্বব্যাপ মানবাধিকার ও প্রতিবাদের প্রতীক’’- আহমেদ বুরিচ। ক্রোয়েশিয়ান এ কলামিস্টের মতে ১৯৬৯ সালে যুগোস্লাভিয়ায় নির্মিত বিখ্যাত থ্রিলার সিনেমা ‘’Most’’ এর একটি দৃশ্যে বরিস ভরনিকের গাওয়া ‘বেলা চাও’ এ গানের বেস্ট সংস্করণ। চিরজীবী এমন কিছু গান হয়ত টিকে থাকবে আরও অনেক দিন, প্রজন্মের পর প্রজন্মে প্রতিবাদ আর উদ্দীপনার খোরাক হয়ে।
তথ্যসূত্রঃ দি ন্যাশনাল.এই, দ্য অপরাহ ম্যাগাজিন, ওয়ার্ল্ডওয়াইড মিউজিক এক্সপো, ওয়েবসাইট।
লেখাঃ ফুয়াদ উদ্দীন অন্তর।