নেক্রোফিলিয়া’ সাবজেক্টটি নিয়ে ভারতে এর আগে কোন সিনেমা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। হয়ে থাকলে তা নিতান্তই আমার খেয়ালে নেই। তাই যদি হয়, তবে ‘অশ্বথামা’ (২০২০) এই সাবজেক্ট তুলে ধরায় ভারতের প্রথম সিনেমা।
★★★ থাকতে পারে কিঞ্চিৎ স্পয়লার সামনে ★★★
‘নেক্রোফিলিক সাইকো’ ! সাইকো কিলার নিয়ে সিনেমা সাউথে এর আগে অনেক হলেও, নেক্রোফিলিক সাইকো নিয়ে এই প্রথম। গল্পের পৃষ্ঠতল সম্বন্ধে ধারণা দিতে গেলে তা দাঁড়ায় এমন-
বোনের বিয়ে উপলক্ষ্যে ভিনদে ফিরেছে বড় ভাই। বিয়ের দুদিন আগে, রাতে ভাই আবিষ্কার করে তার বোন গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে যাচ্ছে। সঠিক সময়ে ভাই হাজির হওয়ায় আত্মহননের পথ থেকে ফিরে আসে বোন। জানায় সত্য। সে প্রেগন্যান্ট। কিন্তু জানে না এই অনাগত সন্তানের পিতা কে ! কারণ কারো সাথে সে দৈহিক সম্পর্কই স্থাপন করেনি। ভাই হন্যে হয়ে খুঁজতে নামে সেই বদমাশকে, কোনরকম ক্লু বিহীন। কদিন পরের ঘটনা। হাসপাতালের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে এক মেয়ে। হাতে গুঁজে ছিল একটি চিঠি। তাতে লেখা, সে প্রেগন্যান্ট। কিন্তু জানে না কে তার এই অবস্থার জন্য দায়ী। দৈবক্রমেই সেখানে উপস্থিত থাকে সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র অর্থাৎ ভাই চরিত্রটি। একই দুটো ঘটনা নাড়া দেয় তাকে। তার বোনের ঘটনাটায় নতুন মোড় আবিষ্কার করে সে। তার বোন একাই নয়। এমন ঘটেছে আরো অনেক মেয়ের সাথে। তারা প্রেগন্যান্ট কিন্তু জানেই না পিতা কে, অপমানের দায় থেকে মুখ লুকাতে বেছে নিয়েছে আত্মহননের পথ। আর সহজ করে দিয়েছে মুখোশের আড়ালে থাকা সাইকোর এমন হেয় কাজকর্ম করে স্বাধীন ঘুরে বেড়ানোর পন্থা। কোনরকম সংযোগবিহীন, সাযুজ্যবিহীন একেকটি আত্মহত্যার কেস নিয়ে এই বিকৃতমনাকে খুনিকে ধরতে বদ্ধপরিকর নায়ক গানা।
অশ্বথামা সিনেমার সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গাটি হলো, এর কোর কনসেপ্ট। এ ধরনের প্রথম হওয়ায় সবকটি সুবিধা এবং যতটুকু ক্রেডিট পাওয়া যায়, তার সবটুকুই নিয়েছে। নিয়েছে বৈ, তবে এই কোর কনসেপ্টের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে কী ? না। বলা যায়, এই কনসেপ্ট নিয়েই দৌড়েছে। পৃষ্ঠতলে থেকেছে। গভীরে যেতে চায়নি এবং সাইকো চরিত্রটিতে আরো পরত যোগ করতে পারার সুযোগ থাকলেও তা করেনি। কনসেপ্টটা মাথায় রেখে, যেই গল্প ফাঁদা হয়েছে, তা বিশেষ নিয়। আসলে তেলেগু ‘জনরা’ সিনেমার লাইনেই থাকতে চেয়েছে, অশ্বথামা। তেলেগু মাসালা সিনেমার সবকটা অলংকারের উপস্থিতি এতে আছে, কখনো প্রকটরূপে কখনোবা প্রচ্ছন্নরূপে। সেসব রেখেই এর চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে। কিন্তু এমন কনসেপ্ট আর এমন সাইকো চরিত্রের প্রতি ন্যায়বিচার এই চিত্রনাট্য করেনি। বেশকিছু ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে চিত্রনাট্য লিখতে গিয়ে। আধাসেদ্ধ পারিবারিক সেন্টিমেন্ট এবং তাতে অতিনাটকীয় কোণ সৃষ্টি করা হয়েছে। তাছাড়া নায়ক গানার সাইকোপ্যাথকে খুঁজে বের করতে হুটহাট যেসব মোড় নিচ্ছেন তা অনেকসময়ই বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। আরো সময় দেওয়া উচিত ছিল এইদিকে।
তবে সিনেমা চালিয়ে নেওয়ায় সাইকো চরিত্রটি নিজেই যথেষ্ট। পর্দায় আবির্ভূত হয়েছে সে সিনেমার দ্বিতীয় অংকে। কিন্তু এর আগে তার আবির্ভাবকে ঘিরে গল্পে যে বেইটগুলো দাঁড় করানো হয়েছে তা বেশ। এবং সাইকো চরিত্রটির স্ক্রিনটাইম কম হলেও তার সম্বন্ধে দর্শক জ্ঞাত হওয়ার পরের মুহূর্ত থেকেই মাইল দূরে থেকেও পর্দায় প্রভাব রেখেছে সে। আর তেমনটি সম্ভব হয়েছে এই চরিত্রে ‘যীশু সেনগুপ্ত’র অভিনয় দক্ষতার কারণেই। চরিত্রটি যেভাবে তিনি রূপায়ন করেছেন, তাতে এই চরিত্রে তার বিকল্প কাউকে ভাবাটা সহজ নয় বৈকি। তার চোখমুখের অদ্ভুত শীতলতা দ্বিগুণ প্রগাঢ়তা দিয়েছে চরিত্রটিকে। সিনেমার নায়ক ‘নাগা শৌরিয়া’ এবং সহচরিত্রের বাকিদের অভিনয় ও ফিকে হয়ে পড়ে যীশু সেনগুপ্তের অভিনয়ের সামনে। নিজের ভয়েজে ডাবিং করতে পারলে হয়তো আরো উচ্চতা পেত তার এই দুর্দান্ত অভিনয়।
ভারতীয় সাইকো নির্ভর সিনেমাগুলোয় সাইকো আর প্রোটাগোনিস্টের যে গড়পড়তা ‘ইঁদুর-বিড়াল’ খেলা চলে এই সিনেমায় আবার তেমনটি গৎবাঁধা নিয়মে ঘটেনি। প্রোটাগোনিস্ট যেমন ক্লু-বিহীন ছুটছিল, খুনী কে হতে পারে তার বিন্দুবিসর্গ না জেনে। ওদিকে খুনীও ঠিকঠাক জানে না, ঠিক কে তার পেছনে আসছে। তাই তার কাজের স্বাভাবিক গতি সে ধরে রাখে। এখানটায় থ্রিলের কমতি মনে হলেও, বরং একটা চাপা রহস্য উল্টো আরো ঘনীভূত হয়েছে। সেটা সিনেমার স্বীয় সার্থের চেয়ে দর্শককে ধরে রাখতে কাজে লেগেছে বেশি। হ্যা, এতে দুই চরিত্রের ইন্টারপ্লে তৈরি হওয়ার সুযোগ পায়নি তা ঠিক।
জনরা সিনেমা হয়ে থাকতেই সে-সমস্ত অলংকার ঘাড়ে নিয়ে তৈরি চিত্রনাট্য, গতিময়তা ধরে রাখা সম্পাদনা আর রীতিসিদ্ধ নিয়মে যথাযথ পরিচালনার সিনেমা অশ্বথামা। এই সিনেমা তামিলে হলে অপেক্ষাকৃত বেটার কিছু হতো। এই টোনের সিনেমা তারাই বেশি করে থাকে সাউথ ইন্ডিয়ায়। এবং আবহ তৈরিতেও তেমনটিই অনুভূত হয়। তামিলে হলে চিত্রনাট্যে বর্ণনা এবং বিবরণ দুটোই আরো বেশি থাকতো। সাইকো চরিত্রটিও আরো নিগূঢ় হতো। মোদ্দাকথা, তারা তেলেগুর মতো শুধু ‘ও-ফ্যাক্টর’ তৈরিতে আঁটকে না থেকে, ‘র-ফ্যাক্টর’টাকেও তুলে আনতে পারতো।
ভিন্ন কনসেপ্টের ভিন্ন সিনেমা হিসেবে নয়, বরং তেলেগু মূলধারার অ্যাকশান, থ্রিলার সিনেমা যেমন হয় তারমাঝে একটু ভিন্ন কনসেপ্টের দেখা পাবো- এমনটা মাথায় নিয়ে দেখতে বসলেই অশ্বথামা সঠিকভাবে উপভোগ করতে পারা যাবে।